পরীমনি যেভাবে ‘পুরুষ দৃষ্টি’র সীমা ভাঙলেন
আকাশের তারাকে আমরা ছুঁতে পারি না, কিন্তু নিজেকে ঢেকে রাখার অধিকার তার নেই। প্রদর্শনীর জন্য সে সদা উপস্থিত। বিনোদন জগতের তারাদের হালও অনেকটা তাই। তাঁদের গোপন ও প্রকাশের সীমারেখা বড়ই অস্পষ্ট এবং ক্রমাগত নির্মাণাধীন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই প্রবাল্যে মেটা–দুনিয়ায় আমাদের সবার জীবনই কি অনেকটা সে রকম নয়?
যাঁরা তারকা, তাঁরা রিল ও ‘রিয়েল লাইফ’ বা পর্দা ও বাস্তবের জীবনকে অনেক সময়ই গুলিয়ে ফেলেন—এটা হলো পুরোনো ও প্রতিষ্ঠিত বয়ান। কিন্তু এখন আমাদের যে বাস্তব, তা অনেক অনেক পর্দার সমষ্টি, যেসব পর্দা প্রতিনিয়তই নানা ধরনের বয়ানের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। আর এই প্রতিফলন ও বিচ্ছুরণ ঘটছে নানান দৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গিতেও। হালফিল সময়ে আমাদের জীবন তাই একটি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল ‘মেকানিজম’, অনেক সময়ই যার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না; এমনকি নিয়ন্ত্রণ থাকছে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ারও সুযোগ থাকছে না!
সম্প্রতি তারকা দম্পতি পরীমনি ও শরীফুল রাজের দাম্পত্য সংকট গোপনীয়তার গণ্ডি পার করে জনপরিসরে চলে এসেছে। সাক্ষাৎকারে পরীমনি নিজেই বলেছেন, ‘আমার সবকিছু পাবলিককে দিয়ে দিলাম।’
পরিবার বা সংসারকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে আদি হেজেমনিক প্রতিষ্ঠান—স্বামী ও স্ত্রী যে প্রতিষ্ঠানের মূল ভিত। একটি কার্যকর সমাজব্যবস্থা অটুট রাখতে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানকে অটুট রাখা জরুরি। তাই পরিবারে ফাটল বা ভাঙন মেরামতে সমাজের মুরব্বিদের এগিয়ে আসার বিষয়টির ঐতিহ্য রয়েছে এই অঞ্চলে। এখনো গ্রামাঞ্চলে বা শহরতলিতে এই প্রথা বিদ্যমান। কিন্তু সজ্ঞানে বা অবচেতনে আমরা যখন মেটা–দুনিয়ার নাগরিকত্ব কবুল করে নিয়েছি, তখন সেখানকার মুরব্বি কে?
মেটা–দুনিয়ার মুরব্বি হলো ‘পাবলিক’, বাংলায় যাদের আমজনতা বলা যেতে পারে। আর তাই কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা ব্যক্তি নয়, এই দুই তারকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিজেদের বয়ান দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন। শুধু তা–ই নয়, সামাজিক মাধ্যমে এসে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করে নিজ নিজ জায়গা থেকে তাঁদের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টাও করলেন। তবে এখানে পর্দায় তাঁদের ক্রমাগত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হলো এবং থাকতে হলো সবার দৃষ্টিসীমায়।
কারণ, পুঁজিবাদী সমাজে কোনো তারকার পক্ষে নিজের জীবনকে খুব ব্যক্তিগত করে রাখা বেশ কঠিন, তিনি চাইলেও পারবেন না। আর এই মেটা–দুনিয়ায় তা তো এখন আরও বেশি দুঃসাধ্য। সব সময় ‘পাবলিক’–এর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেন তারকারা; জনতারূপী ‘পাবলিক’ জানতে চায় তাদের সর্বশেষ আপডেট। এ কারণেই কি রাজ–পরীকে তাঁদের দাম্পত্যের বিষয়–আশয় এবং পরস্পরের প্রতি নিজেদের অভিযোগ–অনুযোগ নিয়ে ‘পাবলিকের আদালত’–এ হাজির হতে হলো? ‘পাবলিক’কে ‘মুরব্বি’ মানতে হলো?
প্রশ্নগুলোর উত্তর আসলে কঠিন। সহজ কথায় এটুকু বলা যায়, এগুলো হলো সমাজের মধ্যে পুঁজিবাদের দানবীয় বিকাশের ফল। আর পুঁজিবাদী সমাজে যদি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার আধিক্য থাকে তাহলে কী ঘটে, তা–ও আমরা এই দুই তারকার সাম্প্রতিক ঘটনাবলি অবলোকন করলে বুঝতে পারব।